“মাদক বাংলাদেশে মহামারি আকার ধারন করেছে”

মোঃ মানসুর আলম সিকদারঃ বাংলাদেশে মাদকাসক্তি বর্তমানে একটি নীরব মহামারি রূপে আবির্ভূত হয়েছে, যা দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ভেতর থেকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। তরুণ প্রজন্ম সবচেয়ে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দেশের ভবিষ্যৎ এক অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত হচ্ছে। এমনকি গ্রাম পর্যায়ে পর্যন্ত পৌছে গেছে। এগুলো নিয়ে বেশ খুনাখুনি পর্যন্ত হচ্ছে।

মাদকের ভয়াবহতার পরিসংখ্যান

বিভিন্ন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৭০ লাখ থেকে দেড় কোটিরও বেশি হতে পারে। এর মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশই তরুণ ও যুবক, যাদের বয়স ১৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে মাদক ব্যবহারকারীদের মধ্যে নারীদের সংখ্যাও প্রায় ১০ শতাংশ। প্রতিদিন শত শত কোটি টাকার মাদক কেনাবেচা হয়, যা দেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

১) বাংলাদেশে মাদকের মহামারির কারণ

বাংলাদেশে মাদকের ভয়াবহ বিস্তারের পেছনে বহুবিধ কারণ জড়িত এগুলো হলো:

ক) ভৌগোলিক অবস্থান: গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল (মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস) এবং গোল্ডেন ক্রিসেন্ট (আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরান)-এর কাছাকাছি হওয়ায় বাংলাদেশ মাদক চোরাচালানের একটি সহজ রুটে পরিণত হয়েছে। মিয়ানমার থেকে আসা ইয়াবা এবং সম্প্রতি ক্রিস্টাল মেথ (আইস) দেশের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি।

খ) সহজলভ্যতা: সীমান্ত পথে চোরাচালানের মাধ্যমে দেশের আনাচে-কানাচে মাদক ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া সীমান্ত এবং সাগরপথ মাদক প্রবেশের প্রধান রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

গ) বেকারত্ব হতাশা: তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বেকারত্ব, হতাশা, এবং মানসিক চাপ তাদের মাদকের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

ঘ) সঙ্গদোষ কৌতূহল: মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৬০ শতাংশ তরুণ-তরুণী বন্ধুদের প্ররোচনায় এবং ৩৬ শতাংশ কৌতূহলের বশে মাদক গ্রহণ শুরু করে।

ঙ) পারিবারিক সামাজিক অবক্ষয়: পারিবারিক কলহ, সন্তানদের প্রতি অভিভাবকদের উদাসীনতা, এবং নৈতিক শিক্ষার অভাব তরুণদের বিপথগামী করছে।

২) প্রচলিত মারাত্মক মাদকসমূহঃ

ক) ইয়াবা: বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত এবং মারাত্মক মাদক। এটি ‘ক্রেজি ড্রাগ’ নামেও পরিচিত এবং মূলত মিয়ানমার থেকে চোরাচালান হয়ে আসে।

খ) ক্রিস্টাল মেথ (আইস): ইয়াবার চেয়েও বহুগুণ শক্তিশালী ও মারাত্মক এই মাদকটি দ্রুত তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে।

গ) হেরোইন: এক সময়ের সবচেয়ে প্রচলিত এই মাদকটির ব্যবহার এখনও ব্যাপক।

ঘ) ফেনসিডিল: কাশির সিরাপ হিসেবে পরিচিত এই মাদকটিও নেশার জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।

ঙ) গাঁজা: সহজলভ্য হওয়ায় এর ব্যবহার শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত।

চ) গামঃ এরা টোকাই শ্রেনীর হয়ে থাকে। এর জুতার গাম ফুকইয়া নেশা করে থাকে। এরাই একসময়ে ভয়ংকর সন্ত্রাসী হয়ে থাকে।

৩) মাদকের সর্বনাশা প্রভাবঃ

ক) মাদকের প্রভাব ব্যক্তি, পরিবার এবং সমাজপ্রতিটি স্তরেই বিধ্বংসী

শারীরিক মানসিক স্বাস্থ্য: মাদকাসক্ত ব্যক্তি অনিদ্রা, ক্ষুধামন্দা, ফুসফুসের ক্যান্সার, হেপাটাইটিস, এইচআইভি/এইডস-এর মতো মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয়। তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের চরম অবনতি ঘটে, স্মৃতিশক্তি লোপ পায় এবং ব্যক্তিত্বের ভারসাম্য নষ্ট হয়।

খ) পারিবারিক সামাজিক অবক্ষয়: মাদকাসক্ত ব্যক্তির পরিবারে অশান্তি, ভাঙন ও কলহ লেগেই থাকে। মাদকের টাকা জোগাড় করতে গিয়ে তারা চুরি, ছিনতাই, এমনকি খুনের মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে, যা সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি করে।

গ) অর্থনৈতিক ক্ষতি: মাদকাসক্ত ব্যক্তি কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে এবং দেশের অর্থনীতিতে তার কোনো অবদান থাকে না। মাদকের পেছনে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হওয়ায় বহু পরিবার সর্বস্বান্ত হয়ে যায়।

ঘ) চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, খুন, সন্ত্রাস এগুলোর প্রায় ৯৮% মাদকসেবীরা করে থাকেঃ মাদকসেবীরা টাকার জন্য এমন কোন খারাপ কাজ নাই যে তারা করতে পারেনা। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, খুন, সন্ত্রাস এগুলোর প্রায় ৯৮% মাদকসেবীরা করে থাকে। মনে হচ্ছে এগুলো যদি নিয়ন্ত্রন করা না যায় তবে এর ভয়ালগ্রাস থেকে জাতী বেড় হতে পারবে না। এজন্য এগুলো বিরুদ্ধে ডোপ টেষ্ট এর মাধ্যমে সনক্ত করে রাষ্ট্রীয়ভাবে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে।  

৪) প্রতিরোধে সরকারি পদক্ষেপঃ

মাদক নিয়ন্ত্রণে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

ক) কঠোর আইন প্রণয়ন: “মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮” প্রণয়ন করা হয়েছে, যেখানে মাদক ব্যবসার জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

খ) আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অভিযান: মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (DNC), পুলিশ, র‍্যাব (RAB) ও বিজিবি (BGB) দেশব্যাপী নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে এবং বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য জব্দ করছে।

গ) সীমান্তে নজরদারি বৃদ্ধি: মাদক চোরাচালান রোধে সীমান্তে, বিশেষ করে মিয়ানমার সীমান্তে, নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।

ঘ) সচেতনতামূলক কার্যক্রম: স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন পর্যায়ে মাদকের কুফল সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য প্রচারণা চালানো হচ্ছে।

ঘ) চিকিৎসা পুনর্বাসন: সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে, যেখানে মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা রয়েছে।

৫) করণীয় উত্তরণের পথঃ

এই মহামারি থেকে মুক্তি পেতে একটি সমন্বিত সামাজিক আন্দোলন অপরিহার্য।

ক. সর্বাত্মক প্রতিরোধ: মাদকের সরবরাহ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে আরও কঠোর ও তৎপর হতে হবে।

খ. আইনের কঠোর প্রয়োগ: মাদক ব্যবসায়ী এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকদের কোনো প্রকার ছাড় না দিয়ে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

গ. ব্যাপক জনসচেতনতা: পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমের মাধ্যমে মাদকের বিরুদ্ধে শক্তিশালী সামাজিক সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।

ঘ. কর্মসংস্থান সুস্থ বিনোদন: তরুণদের জন্য কর্মসংস্থান এবং খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডসহ সুস্থ বিনোদনের সুযোগ বাড়াতে হবে।

ঙ. পারিবারিক ভূমিকা: প্রতিটি পরিবারকে তাদের সন্তানের প্রতি আরও যত্নশীল হতে হবে এবং তাদের নৈতিক শিক্ষা প্রদান করতে হবে।

প্রয়োজনে দেশের বৃহত্তর সার্থে রাষ্ট্রকে ডোপ টেষ্টের মাধ্যমে মাদক সেবীদের চিহ্নিত করে নিষ্ঠুর অনাকাঙ্খীত কঠোর অবস্থানে যেতে হবে। মাদকাসক্তির এই ভয়াবহ বিস্তার রোধ করা না গেলে আমাদের তরুণ প্রজন্ম ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাবে এবং দেশের সার্বিক উন্নয়ন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। তাই সরকার, সমাজ এবং ব্যক্তি—সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে এই নীরব মহামারি থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করতে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *