বাংলাদেশে আর্থিক সংকট কেড়ে নিচ্ছে যথাযথ চিকিৎসার অধিকার

মোঃ মানসুর আলম সিকদারঃ ঢাকা, বাংলাদেশ – বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক নাগরিকের জন্য মানসম্মত চিকিৎসা সেবা যেন এক সুদূরপরাহত স্বপ্ন। এর প্রধান অন্তরায় হিসেবে দাঁড়িয়েছে অপর্যাপ্ত আর্থিক সংগতি। দেশের স্বাস্থ্যখাতে বিরাজমান নানা সংকট এবং সাধারণ মানুষের আয়ের স্বল্পতা একযোগে এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। ফলস্বরূপ, জনসংখ্যার এক বিশাল অংশ ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যা তাদের জীবন ও জীবিকার উপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

সাম্প্রতিক বিভিন্ন প্রতিবেদন এবং পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা মূলত ব্যক্তিনির্ভর। অর্থাৎ, চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সিংহভাগই নাগরিকদের নিজেদের পকেট থেকে খরচ করতে হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, এই ব্যক্তিগত খরচের (আউট-অফ-পকেট এক্সপেন্ডিচার) পরিমাণ মোট স্বাস্থ্যখাতের প্রায় ৬৯ শতাংশ, যা এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ। কোনো কোনো সমীক্ষায় এই হার ৮০ শতাংশের কাছাকাছি বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। এর অনিবার্য পরিণতি হিসেবে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় মেটাতে গিয়ে নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। একটি বেসরকারি গবেষণা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে বছরে প্রায় ৬৪ লক্ষ মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়ছে এবং ৮৬ লক্ষেরও বেশি মানুষের আর্থিক অবস্থা আরও শোচনীয় হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সংকটের মূলে রয়েছে স্বাস্থ্যখাতে অপর্যাপ্ত সরকারি বিনিয়োগ। বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) মাত্র ১ শতাংশেরও কম স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় করা হয়, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশকৃত মাত্রার চেয়ে অনেক কম। সরকারি বরাদ্দের স্বল্পতার কারণে হাসপাতালগুলোতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, আধুনিক যন্ত্রপাতি এবং দক্ষ জনবলের তীব্র সংকট রয়েছে। ফলে, রোগীরা একদিকে যেমন সরকারি হাসপাতালে যথাযথ সেবা পাচ্ছেন না, তেমনই অন্যদিকে বেসরকারি হাসপাতালের ব্যয়বহুল চিকিৎসা গ্রহণ করতেও তারা অক্ষম।

গ্রামাঞ্চলের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। সেখানে স্বাস্থ্য অবকাঠামো অত্যন্ত দুর্বল এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা নগণ্য। ফলে, গ্রামের মানুষকে চিকিৎসার জন্য শহরের দিকে ছুটতে হয়, যা তাদের সময় এবং অর্থ উভয়েরই অপচয় ঘটায়। এছাড়া, রোগ নির্ণয়ের জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার উচ্চমূল্য এবং ওষুধের ক্রমবর্ধমান দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য স্বাস্থ্যখাতে সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি, সর্বজনীন স্বাস্থ্যবীমা চালু করা এবং ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণের মতো কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা অপরিহার্য বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, দেশের সব নাগরিকের জন্য সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা কেবল মানবিক দায়িত্বই নয়, এটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেরও অন্যতম পূর্বশর্ত। স্বাস্থ্যবান নাগরিকরাই একটি দেশের উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি, এবং এই সত্যকে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *