বাংলাদেশের অধিকাংশ নাগরি যথাযথ চিকিৎসা পাচ্ছে না

সাহানা আক্তারঃ বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক নাগরিকের কাছে যথাযথ চিকিৎসাসেবা পৌঁছাচ্ছে না, এটি একটি কঠিন বাস্তবতা। যদিও বিগত দশকগুলোতে দেশের স্বাস্থ্যখাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে, যেমন – গড় আয়ু বৃদ্ধি, মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস ইত্যাদি, কিন্তু সার্বিক স্বাস্থ্যসেবার মান এবং সকল নাগরিকের জন্য এর প্রাপ্যতা এখনও বড় চ্যালেঞ্জ।

বেশ কিছু গভীর এবং পরস্পর সম্পর্কিত কারণে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ যথাযথ চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এর প্রধান কারণগুলো হলো:

১. অপ্রতুল অবকাঠামো ও জনবল সংকট

  • চিকিৎসক-রোগীর অসম অনুপাত: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) সুপারিশ অনুযায়ী, প্রতি ১,০০০ মানুষের জন্য অন্তত ১ জন চিকিৎসক থাকা প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে এই অনুপাত অনেক কম, যা চিকিৎসকদের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে এবং রোগীদের মানসম্মত সেবা পাওয়া কঠিন করে তোলে।
  • গ্রাম ও শহরের বৈষম্য: অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং আধুনিক হাসপাতাল ও ক্লিনিক শহর-কেন্দ্রিক, বিশেষ করে ঢাকা কেন্দ্রিক। ফলে গ্রামের বা মফস্বলের মানুষ গুরুতর রোগের জন্য মানসম্মত ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হয়। গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে প্রায়ই চিকিৎসক, নার্স এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদির অভাব দেখা যায়।

২. চিকিৎসার উচ্চ ব্যয় এবং ব্যক্তিগত খরচের বোঝা

  • ব্যক্তিগত খরচের আধিক্য (Out-of-Pocket Expenditure): বাংলাদেশে চিকিৎসার জন্য মোট খরচের একটি বিশাল অংশ (প্রায় ৭৩%) রোগীদের নিজেদের বহন করতে হয়। যেখানে সরকারি বাজেটের অংশ খুবই কম। এর ফলে, বিশেষ করে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো আকস্মিক অসুস্থতায় মারাত্মক আর্থিক সংকটে পড়ে। অনেকে জমিজমা বিক্রি করে বা ঋণ করে চিকিৎসা চালাতে বাধ্য হয়, যা তাদের দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দেয়।
  • ঔষধ ও ডায়াগনস্টিক পরীক্ষার উচ্চমূল্য: চিকিৎসার ব্যয়ের একটি বড় অংশ ঔষধ কেনা এবং বিভিন্ন রোগ নির্ণয়কারী পরীক্ষার পেছনে খরচ হয়, যা অনেকের সামর্থ্যের বাইরে।

৩. ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা ও জবাবদিহিতার অভাব

  • দুর্নীতি ও অনিয়ম: স্বাস্থ্যখাতে যন্ত্রপাতি কেনাকাটা, ঔষধ সরবরাহ এবং নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি একটি বড় সমস্যা। এর ফলে সরকারি হাসপাতালের সেবা ব্যাহত হয় এবং জনগণ সঠিক সেবা পায় না।
  • তদারকির অভাব: সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকদের উপস্থিতি, সেবার মান এবং সরঞ্জামের সঠিক ব্যবহার নিয়মিত তদারকির অভাবে নিশ্চিত করা যায় না। অনেক সময় প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসকদের অনুপস্থিতি একটি সাধারণ অভিযোগে পরিণত হয়েছে।
  • বেসরকারি খাতের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা: নিয়ন্ত্রণের অভাবে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে প্রায়ই অতিরিক্ত বিল এবং অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষার মাধ্যমে রোগীদের হয়রানি করা হয়, যা দেখার মতো কোনো শক্তিশালী কর্তৃপক্ষ নেই।

৪. অপর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ

বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্যখাতের জন্য বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। এটি মোট জিডিপির (GDP) মাত্র ১ শতাংশের কাছাকাছি, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রস্তাবিত ন্যূনতম ৫ শতাংশের চেয়ে অনেক নিচে। এই স্বল্প বরাদ্দের কারণে নতুন হাসপাতাল নির্মাণ, পুরাতনগুলোর আধুনিকায়ন, নতুন চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগ এবং সার্বিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন সম্ভব হয় না।

৫. সচেতনতা ও শিক্ষার অভাব

অনেক মানুষ, বিশেষ করে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী, রোগ প্রতিরোধ এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা সম্পর্কে সচেতন নয়। অসুস্থ হলে অবহেলা করা বা হাতুড়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। ফলে রোগ জটিল আকার ধারণ করলে তখন চিকিৎসার খরচ ও ঝুঁকি দুটোই বেড়ে যায়।

সরকারি উদ্যোগসমূহ

এই সমস্যাগুলো মোকাবেলায় সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

  • কমিউনিটি ক্লিনিক: গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য দেশব্যাপী প্রায় ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হয়েছে। এখান থেকে ৩০ প্রকারের ঔষধ বিনামূল্যে প্রদান করা হয়।
  • ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা: টেলিমেডিসিন এবং বিভিন্ন মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
  • হাসপাতাল সম্প্রসারণ: উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোর শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি এবং সেবার মান উন্নয়নের চেষ্টা চলছে।

উত্তরণের পথ

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য একটি সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রয়োজন:

  • বাজেট বৃদ্ধি: স্বাস্থ্যখাতে জিডিপির অন্তত ৩-৫ শতাংশ বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে।
  • বিকেন্দ্রীকরণ: জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোকে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দিয়ে শক্তিশালী করতে হবে, যাতে চিকিৎসার জন্য মানুষকে ঢাকা আসতে না হয়।
  • সার্বজনীন স্বাস্থ্যবীমা: সকল নাগরিকের জন্য স্বাস্থ্যবীমা চালু করা গেলে চিকিৎসার ব্যক্তিগত খরচ কমবে এবং মানুষ আর্থিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাবে।
  • শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি: সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতেই দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ এবং নিয়মিত তদারকি প্রয়োজন।
  • জনবল নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ: পর্যাপ্ত সংখ্যক চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ এবং তাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। গ্রামে কাজ করার জন্য বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ, যা মোকাবেলায় সরকারের সদিচ্ছার পাশাপাশি শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, পর্যাপ্ত বিনিয়োগ এবং কার্যকর বাস্তবায়ন অপরিহার্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *