নন-লাইফ অত্যন্ত সম্ভাব্য খাত কিন্তু এগুচ্ছে না

মোঃ মানসুর আলম সিকদারঃ নন-লাইফ বীমা খাতের সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও, এ খাতটি এগোচ্ছে না কারণ অবৈধ কমিশন, এজেন্ট প্রথার বিলুপ্তি, অতিরিক্ত প্রিমিয়াম হার, দাবি পরিশোধে অনীহা এবং কিছু কোম্পানির হাতে বাজারের অস্থিতিশীলতা এর প্রধান কারণ। এছাড়া, ডলার সংকট ও রাজনৈতিক অস্থিরতা আমদানি-রফতানিভিত্তিক মেরিন ইন্স্যুরেন্স ব্যবসাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। 

মূল কারণগুলোঃ

১) অবৈধ কমিশন: নির্ধারিত কমিশনের বাইরেও অবৈধভাবে কমিশন প্রদান করা হচ্ছে, যা নতুন কৌশল ব্যবহার করে চলছে এবং এই খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

২) এজেন্ট প্রথার বিলুপ্তি: এজেন্ট প্রথা বিলুপ্ত করার প্রক্রিয়া এবং সেটিকে সঠিকভাবে সম্পন্ন না করার কারণে ব্যবসা সংগ্রহে সমস্যা হচ্ছে।

৩) অতিরিক্ত প্রিমিয়াম হার: আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় প্রিমিয়াম হার বেশি হওয়া এবং এজেন্ট খরচ কমানোর জন্য উন্নয়ন কর্মকর্তাদের এজেন্ট হিসেবে রূপান্তর করার প্রক্রিয়াটিও ধীরগতিতে চলছে।

৪) দাবি পরিশোধে অনীহা: গ্রাহকরা তাদের দাবির টাকা পেতে দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করেন, যা বীমার প্রতি আস্থা কমিয়ে দেয়।

৫) বাজারের অস্থিতিশীলতা: কয়েকটি পরিবার/কোম্পানি বাজারের উপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অস্থিতিশীলতা তৈরি করেছে, যা বীমা খাতের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা কঠিন করে তুলেছে।

৬) অর্থনৈতিক কারণ: ডলার সংকট ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে আমদানি-রফতানি কমে গেছে, যা মেরিন ইন্স্যুরেন্সের মতো বড় একটি ব্যবসায়িক অংশকে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

৭) ত্রুটিপূর্ণ বীমা-ষ্ট্যাম্প প্রয়োগ নীতিঃ অনভিজ্ঞ কতিপয় ব্যক্তি দ্বারা ত্রুটিগতভাবে বীমা-ষ্ট্যাম্পের হার পরিবর্তন করা হয়েছে যা বীমা সেক্টরে কতিপয় বীমার প্রকল্প গ্রহনে অনিহা প্রকাশ করছেন গ্রাহক।

ব্যাংকার ও আমদানী কারকের দেয়া তথ্য সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে অধিকাংশ কোম্পানি ৫০ থেকে ৬৫ শতাংশ কমিশনে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসলামী ধারার ব্যাংক সমূহের কয়েকজন ব্যাংকার জানান, বীমা কোম্পানীগুলোর এই কমিশন প্রতিযোগীতায় ব্যাংকারদের জন্যও বিপজ্জনক। তারা আরো জানান, অনেক ক্লাইন্ট বীমার বিষয়টি ব্যাংকারদের দায়ীত্বে রেখে যায়। নন লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোর কমিশনের প্রতিযোগীতার কারনে অনেক সময় গ্রাহকের সন্দেহের চোখে দেখে।এ বিষয়টি উত্তরন হওয়া উচিৎ বলেও তারা জানান।

জানা যায়, আইডিআরএ গঠিত হওয়ার পর ২০১২ সালে নন লাইফ বীমা খাতের কমিশন প্রথা বাতিল করে ১৫ শতাংশ এজেন্ট কমিশন নির্ধারন করে।তখন বলা হয়েছিল এ পদক্ষেপে নন লাইফ বীমা খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে। কয়েকদিন বন্ধ থাকার পর কমিশন আগের সীমায় পৌছে বলে জানান এ খাতের অনেক। ২০২১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি একই নির্দেশনা জাড়ি করে আইডিআরএ ।এতে বলা হয়েছিল, ১ মার্চ থেকে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে।


২০২১ সালে কয়েক মাস কমিশন প্রথা কিছুটা নিয়ন্ত্রিত থাকলেও ২০২২ সাল থেকে অসম এ কমিশন প্রথা পুরোদমে শুরু হয়। আইডিআরএ উচ্চ পর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তার কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তারা বলেন, নন লাইফ বীমা খাতে কমিশন ১৪.২৫ শতাংশ। এর বেশি কমিশন আছে বলে তাদের জানা নেই।

আইডিআরএ’র কর্মকর্তাদের বক্তব্য সম্পর্কে কয়েকজন বীমাবিদের মতামত চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন, ওনারা আসলে বাংলাদেশে বসবাস করেন কিনা? যদি বাংলাদেশে বসবাস করে থাকেন বীমা খাতের কমিশনের বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। বীমা খাত সংশ্লিষ্ট সকলেই জানেন ৫০ থেকে ৬৫ শতাংশ কমিশন দিয়ে ব্যবসা করছে। এত বড় একটি গুরুত্বপূর্ন বিষয় তাদের কেন জানা থাকবে না,অবশ্যই এটি রহস্যজনক।


এদিকে,আইডিআরএ’র দায়ীত্বশীল একটি সূত্র জানায়, রেগুলেটরি অথরিটি হিসেবে আইডিআরএ’র জনবল কাঠামো অত্যন্ত দূর্বল।এ দূর্বল কাঠামো দিয়ে আসলে এত বড় একটি খাত মনিটরিং করা বাস্তবে কঠিন।এ খাতকে অনিয়ম ও দূর্ণীতি মুক্ত করতে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ ও রেগুলেটরি বডির জনবল কাঠামোর পরিবর্তন। এত স্বল্প পরিমান জনবল দিয়ে বীমা খাতের জঞ্জাল পরিষ্কার করা মোটেও সম্ভব নয়।

সূত্রটি আরো জানায়, লাইফ বা নন লাইফ বীমা কোম্পানির মালিকরা হয় রাজনৈতিকভাবে অথবা আর্থিকভাবে ব্যাপক প্রভাবশালী। এই প্রভাবশালীদের পরিচালনাধীন কোম্পানিসমূহের বিরুদ্ধে কোন প্রকার কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে টিকে থাকাও একটি গুরুত্বপূর্ন বিষয়।


অপর একটি সূত্র জানায়, মনে করা হয়েছিল দেশের পট পরিবর্তনের পর দেশের বীমা খাতে ব্যাপক পরিবর্তনের ছোয়া লাগবে। বাস্তবে তা হয় নি বরং পরিস্থিতি আরও অবনতি হয়েছে।

আইডিআরএর নন-লাইফ সংশ্লিষ্ট বিভাগের উর্ধতন একজন কর্মকর্তার কাছে কোম্পানিগুলো ৬৫ শতাংশের উপরে কমিশন বাবদ খরচ করে, ব্যবস্থাপনা ব্যয় ৬০শতাংশের নিচে প্রদর্শন করছে এটি কিভাবে সম্ভব এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশের বীমা খাতে সব সম্ভব। আপর একটি সূত্র জানান, বাংলাদেশের বীমা খাতে সরল অংক সরলভাবে ফলাফল প্রদর্শন করতে অক্ষম। এ খাতে সব অনিয়মই নিয়ম। এগুলো থেকে প্রতিষ্ঠানগুলোকে উত্তোরন ঘটাতে হবে। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাধবে কে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *