ভূমিকাঃ শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কনিষ্ঠপুত্র আরাফাত রহমান কোকো। তিনি ছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী। তিনি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও ওল্ড ডিওএইচএস ক্লাবের সাবেক চেয়ারম্যান ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক, ক্রীড়া সাংস্কৃতিক কর্মকা-ন্ডের সঙ্গে ওতোপ্রোত ভাবে জড়িত ছিলেন।
আরাফাত রহমানের জন্ম ও বেড়ে উঠা: শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কনিষ্ঠপুত্র আরাফাত রহমান কোকোর জন্ম ১৯৬৯ সালে ঢাকায়। ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গ্রেফতারের আগ পর্যন্ত মা বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গেই ছিলেন আরাফাত রহমান কোকো।
শিক্ষা জীবনঃ শিক্ষা জীবনে শিক্ষাজীবন শুরু করেছিলেন বিএএফ শাহীন স্কুলে। এরপর বাবা জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বেগম খালেদা জিয়া রাজনীতিতে যোগ দিয়ে জাতীয়তাবাদী দলের হাল ধরলে মা তাকে পাঠিয়ে দেন চাচার কাছে যুক্তরাজ্যে। এখান থেকেই তিনি ও লেভেল শেষ করে আমেরিকা চলে যান। আমেরিকা থেকে এ লেভেল শেষ করেন। এরপর তিনি অস্ট্রেলিয়া থেকে সিভিল এভিয়েশনে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহন করেন।
১৯৬৯ সালে বন্দিঃ ১৯৬৯ সালে জিয়াউর রহমান স্বপরিবারে ঢাকায় চলে আসলে কিছুদিন জয়দেবপুরে থাকার পর বাবা জিয়াউর রহমানের চাকরির সুবাদে চট্টগ্রামের ষোলশহর এলাকায় বসবাস করেন তারা। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে মায়ের সাথে কিছুদিন আত্মগোপন করে থাকার পর ১৬ মে নৌপথে পরিবারের সাথে ঢাকায় চলে আসেন কোকো। এরপর বড় খালা খুরশিদ জাহানের বাসায় ১৭ জুন পর্যন্ত থাকেন পরিবারের সবাই। ২ জুলাই সিদ্ধেশরীতে জনাব এস আব্দুল্লাহর বাসা থেকে পাক সেনারা মা ও বড়ভাই তারেকসহ আরাফাত রহমান কোকোকে বন্দি করে। তাঁরা ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দি ছিলেন। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে মা-ভাইসহ তিনি মুক্তি পান।
ব্যক্তি জীবনে বাবা জিয়াউর রহমান সাবেক সেনাবাহিনীর প্রধান ও রাষ্ট্রপতি, মা বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী, এবং বড় ভাই তারেক রহমান বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হলেও আরাফাত রহমান কোকো ছিলেন অনেকটা পর্দার আড়ালে। রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ তার ছিল না। ব্যবসা বাণিজ্যসহ সামাজিক কর্মকান্ডেই সময় ব্যয় করতেন তিনি।
জেল-জুলুম, প্রবাসী জীবন গ্রহন: ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির মাধ্যমে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এলে জিয়া পরিবারের উপর নেমে আসে রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের খড়গ। একই বছরের ৩ সেপ্টেম্বর ভোরে সেনানিবাসের বাড়ি থেকে মা বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে গ্রেফতার হন তিনি। সেনা সমর্থিত সরকারের অমানুষিক নির্যাতনে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে বিদেশে চিকিৎসার জন্য প্যারোলে মুক্তি দেয়া হয় তাকে।
২০০৮ সালের ১৮ জুলাই চিকিৎসার জন্য সপরিবারে ব্যাংকক যান আরাফাত রহমান কোকো। এরপর চিকিৎসা শেষে তিনি মালয়েশিয়াতে চলে যান এবং সেখানেই সপরিবারে বসবাস করে আসছিলেন।
২০১২ সালে খালেদা জিয়া সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা করাতে গেলে সেখানে কোকোর সাথে সিঙ্গাপুরে সাক্ষাত করেন তিনি। সবশেষ ২০১৪ সালে সৌদি আরবে জিয়া পরিবার একত্রিত হলেও আসতে পারেননি আরাফাত রহমান কোকো।
কোকোর বিরুদ্ধে যত মামলা: জরুরি অবস্থার সেনা সমর্থিত সরকারের সময় দেশের অন্যান্য ব্যাবসায়ীদের মতো তিনিও হয়রানির শিকার হন। বিভিন্ন অভিযোগে তার বিরুদ্ধে সাতটি হয়রানিমূলক মামলা দেয়া হয়।
মামলাঃ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কোকোর বিরুদ্ধে গুলশান থানায় দুটি চাঁদাবাজির মামলা এবং অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে একটি মামলা করে দূর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সোনালী ব্যাংকের ঋণখেলাপের মামলায় ভাইয়ের (তারেক রহমান) সঙ্গে এবং গ্যাটকো দুর্নীতি মামলায় মা বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে তাকেও আসামি করা হয়।
এরপর বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ২০০৯ সালের ১৭ মার্চ সিঙ্গাপুরে ২০ কোটি টাকার বেশি অর্থের অবৈধ লেনদেনের অভিযোগে কাফরুল থানায় আরাফাত রহমান কোকোর বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। ২০১১ সালের ২৩ জুন এ মামলার রায় হয়। মামলায় পলাতক দেখিয়ে কোকোকে ছয় বছরের সশ্রম কারাদ-ন্ডাদেশ দেন আদালত। একই সঙ্গে সাড়ে ১৯ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়। কোকোর বিরুদ্ধে আয়কর ফাঁকির অভিযোগে ২০১০ সালের ১ মার্চ আরেকটি মামলা করে এনবিআর।
পারিবারিক জীবন: পারিবারিক জীবনে আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলী রহমান এবং জাফিয়া রহমান ও জাহিয়া রহমান নামে দুই মেয়ে রয়েছে। তারাও বর্তমানে তার সঙ্গে মালয়েশিয়াতে বসবাস করছেন। প্রায় সাত বছর ধরে তিনি নির্বাসিত জীবন যাপন করে আসছিলেন।
ক্রীড়াঙ্গনে আরাফাত রহমান কোকো: তিনি ২০০২-২০০৫ সনে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন। এই সময় বিসিবির গেমস ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যানও ছিলেন। এছাড়া ক্রীড়া সংঘ ওল্ড ডিওএইচ এর চেয়ারম্যান ছিলেন। যুক্ত ছিলেন সিটি ক্লাবের সাথেও। শের-ই-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম ও বগুড়া শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামের রূপকার তিনি। তাঁর মৃত্যুতে শোক জানায় বিসিবি ও কোয়াব।
তিনি ক্রিকেটকে মিরপুর ও চট্টগ্রামে কেন্দ্রীভূত না করে সিলেট, খুলনা, বগুড়া ও রাজশাহীতে আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়াম নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। এ ছাড়া ক্ষমতায় থাকার পরও বগুড়ার একমাত্র আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়াম শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নামে না করে মুক্তিযোদ্ধা শহীদ চান্দু নামে নামকরণ করে অনন্য নজির স্থাপন করেন।
ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে অস্ট্রেলিয়ান কোচ, ট্রেনার, ফিজিও আনার ট্রেন্ড চালু করেন কোকো। বোর্ডের প্রফেশনাল কাজেও ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার সাপোর্ট পাওয়া যেত। ক্রিকেট বোর্ডকে করেছিলেন রাজনীতিমুক্ত। কাজটি করতে গিয়ে জনপ্রিয়তা বা বাহবা কুড়াতে যাননি কোকো। প্রেসকে ডেকে কভারেজের আয়োজন করেননি। প্রধানমন্ত্রীর ছেলে হওয়া সত্ত্বেও সব মতের সংগঠকরাই ছিলেন তৎকালীন ক্রিকেট বোর্ডে।
২০০০ সালের প্রথম দিকে, আরাফাত রহমান কোকো তার ফুটবল ক্লাব প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন, যা উল্লেখযোগ্যভাবে স্থানীয় যুবকদের মধ্যে ফুটবলের জনপ্রিয়তা বাড়াতে সাহায্য করেছে। এই ক্লাবটি শুধু প্রতিযোগিতা নয়, বরং প্রশিক্ষণ, শিক্ষা এবং জনসচেতনতারও কেন্দ্রবিন্দু ছিল। কোকো বিভিন্ন প্রকারের ক্রীড়া কার্যক্রমের আয়োজন করে তরুণদের নিয়োজিত করার উদ্দেশ্যে নানা কর্মসূচি চালু করেন।
২০০৪ সালে প্রথম অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপের আয়োজনের দায়িত্ব পায় বাংলাদেশ কোকোর কারিশমাতেই। সে সময় তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ এত বড় আয়োজনের উৎসবে পানি ঢেলে দেওয়ার জন্য সারা দেশে হরতাল ডেকেছিল। সেই প্রতিকূল অবস্থায়ও এক দিনে ১৫টি প্র্যাকটিস ম্যাচ আয়োজন করে সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয় বাংলাদেশ। সফল এই আয়োজনের নেপথ্য কারিগর ছিলেন কোকো। তিনি ছিলেন নির্লোভ, নির্মোহ, অরাজনৈতিক ক্রীড়া সংগঠক।
মৃত্যুঃ এদিকে আগেই থেকেই শ্বাসকষ্ট জনিত রোগে অসুস্থ ছিলেন আরাফাত রহমান কোকো। সবশেষ ২৪ জানুয়ারি শনিবার তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হলে তাকে মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি মালায়া হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
এক/এগারো-পরবর্তী সরকারের আমলে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শক্তির রোষানলে পড়ে জিয়া পরিবার। তিনি ও তাঁর ভাই তারেক রহমানের ওপর চালানো হয় নির্মম নির্যাতন। দেশ ছেড়ে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমাতে হয় তাঁকে। সেখানে ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মামলাগুলো মাথায় নিয়ে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর খবরে সারা দেশে শোকের ছায়া নেমে আসে। ২৭ জানুয়ারি সরকারবিরোধী কর্মসূচির সময় দেশে কর্তৃত্ববাদী সরকারের প্রায়-কারফিউ অবস্থার মধ্যে বায়তুল মোকাররমে তাঁর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
জানাজাঃ গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, সেদিন বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেট থেকে মওলানা ভাসানী হকি স্টেডিয়াম, মহানগর নাট্যমঞ্চ, গোলাপ শাহর মাজার থেকে জিপিও মোড় পর্যন্ত সড়কে অবস্থান নেয় মানুষ। অন্যদিকে বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেট থেকে পল্টন মোড়, দৈনিক বাংলা মোড় ও জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ এলাকায় লাখো মানুষ সমবেত হয়। ঢাকা ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর থেকে অসংখ্য মানুষ জানাজায় অংশ নেয়।
একজন প্রচারবিমুখ, সাদাসিধে কোকোর শেষ বিদায়ে লাখ লাখ মানুষ সেদিন ডুকরে কেঁদেছিল। বাবা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মতো কোকোর জানাজাও বাংলাদেশের ইতিহাসে ছিল বিস্ময়কর। একটি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে সব ভয় আর প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে সেদিন সাধারণ মানুষ চোখের জলে বিদায় জানায় এই অমর ক্রীড়াশিল্পীকে।
আরাফাত রহমান কোকো ক্রিড়া পরিষদঃ “আরাফাত রহমান কোকো ক্রিড়া পরিষদের সম্মানিত কেন্দ্রীয় সভাপতি মোঃ সাইফুল ইসলাম রাশেদ, সম্মানিত উপদেষ্টা ডঃ নজরুল ইসলাম খান, কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি দিদারুল আলম দিদার, মোঃ মানসুর আলম সিকদার, জয়নাল আবেদিন আরজু (ভারপ্রাপ্ত সাধারন সম্পাদক), কেন্দ্রীয় কমিটির অর্থ সম্পাদক মোঃ নজরুল ইসলাম এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও ঢাকা বিভাগীয় সম্পাদক মোঃ নাসির উদ্দিন মিলন।
লেখকঃ মোঃ মানসুর আলম সিকদার